১৯৮৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। রাত ১০টা ১৫। শীত তখনও শহরে জেঁকেই রয়েছে। ভিড়ের বোঝা কমলেও গড়িয়াহাটের ফুটপাতে আড্ডা চলছিল তখনও। হঠাৎ দমকলের গাড়ি দেখেই নড়েচড়ে বসল গড়িয়াহাটের মোড়। ‘আগুন লেগেছে’! ‘বণিকবাড়িতে আগুন!’ সেখান থেকে আরও একটু রটনা, ‘বণিকবাড়িতে আগুন লেগে বড়বউটা পুড়ে গিয়েছে’। শুধুই কি রটনা? সময় অন্তত তা বলেনি।
—‘হ্যালো... লালবাজার কন্ট্রোল।’
—‘তাড়াতাড়ি গড়িয়াহাটের বণিকবাড়িতে লোক পাঠান। সবাই মিলে বউটাকে খুন করেছে। দেরি করলে বডি সরিয়ে নেবে।’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই ফোন রেখে দিয়েছিলেন ওই ব্যক্তি। ‘গড়িয়াহাটের বণিকবাড়ি!’ এটাই একমাত্র ‘কিওয়ার্ড’। লালবাজার থেকে অ্যালার্ট করা হল গড়িয়াহাট থানাকে। ওসি হীরালাল মজুমদার তখন থানাতেই। বণিকবাড়ি তিনি চেনেন। থানা থেকে মিনিট চারেকের হাঁটাপথ। দু’জন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়েই ছুটলেন তিনি। দশতলা ফ্ল্যাট। সিঁড়ি বেয়েই উঠে গেলেন তিনি। পাঁচতলা। বন্ধ কোলাপসেবল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে শুরু হল ডাকাডাকি। সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল ঘরের সব আলো। থেমে গেল ভিতর থেকে আসা গলার আওয়াজ। হীরালালবাবু বুঝলেন, গোলমাল আছে।
গড়িয়াহাট থানা, কেস নম্বর ৪৯। ধারা ১২০বি, ৩০২, ২০১ ও ৩৪ আইপিসি। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, খুন, প্রমাণ লোপাট ও একই অপরাধের উদ্দেশ্যে একের অধিক ব্যক্তির পরিকল্পনা। ঘটনা হল, সেই রাতে নয়, দেবযানী মারা গিয়েছিলেন কয়েক রাত আগেই। তবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নয়। ৩০’এর রাতে শুধু দেহটা উদ্ধার হয়েছিল। মৃতদেহের গন্ধ বেরনোর পর।
রাত গড়াচ্ছে। পাল্লা দিয়ে গড়িয়াহাট থানার ওসি হীরালাল মজুমদারও গলা তুলছেন। ‘শেষবারের মতো বলছি, যে বা যাঁরা ভিতরে আছেন, বেরিয়ে আসুন। নইলে দরজা ভাঙতে বাধ্য হব।’ ১০ মিনিটের মধ্যে যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির দমকল। আগুন নেভাতে নয়। দরজা ভাঙতে। সাক্ষী, স্থানীয় চারজন। দরজা খুলতেই ফ্ল্যাটের ভিতর কাজল কালো অন্ধকার। দাঁড়িয়ে আছেন তিন মহিলা। ওসির ধমক, ‘দরজা খুলছিলেন না কেন?’ শুরু হল দেবযানীর সন্ধান। পাঁচতলার একটা ঘরে তখন তিন শিশু ঘুমাচ্ছে। একজন অসুস্থ মহিলা শুয়ে আছেন। আর একটি ঘরে বছর বারোর এক কিশোর। ঘুমাচ্ছে সেও। তিন মহিলাকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘বাড়ির বউয়ের নাম দেবযানী বণিক? তিনি কোথায়?’ সকলে চুপ। এক এক করে ঘরগুলোতে খুঁজতে শুরু করলেন হীরালালবাবু। উত্তর-পূর্বের ছোট ঘরটার কাছাকাছি যেতেই দেহপচা গন্ধ। দরজা ঠেলতেই নাকে রুমাল দিতে হল। বারান্দায় একটি ফোল্ডিং খাট। তার উপর ও নীচে জামাকাপড়-লেপ-কম্বলের স্তূপ। জামাকাপড়ের স্তূপ সরাতেই বেরিয়ে এল তরুণীর রক্তাক্ত মৃতদেহ। পরণে শাড়ি-ব্লাউজ। শরীর ফুলে পচন ধরেছে। নাকমুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে শুকিয়ে গিয়েছে। শাড়িতে শক্ত হয়ে চেপে বসেছে রক্তের দাগ। গলায় ফাঁসের গাঢ় দাগ। তলব করা হল তিন মহিলাকে। ‘চেনেন?’ সকলের উত্তর... ‘না’। অথচ তাঁরা ওই পরিবারেরই পরিজন! ঘুম থেকে তোলা হল ওই কিশোরকে। ‘চেনো?’ কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। ধরা গলায় শোনা গেল, ‘বউদি’।
—‘কী নাম?’
—‘দেবযানী... দেবযানী বণিক।’
রাতেই ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন ডিসি হেডকোয়ার্টার, ডিসি ডিডি, ডিসি সাউথ, হোমিসাইড শাখার অফিসার। তদন্তভার গেল হোমিসাইড শাখার সাব ইনসপেক্টর সুজিত সান্যালের কাঁধে। ভিড় বাড়ছে গড়িয়াহাট চত্বরে। কৌতূহলী মুখের। আজও গড়িয়াহাট চত্বরে ‘বণিকবাড়ি’ নামটা শুনলেই আদি বাসিন্দারা একবার প্রশ্নকর্তাকে মেপে নেন। সেই সময় বাবার দোকানে সবেমাত্র আসা-যাওয়া শুরু করেছিলেন অজয় (নাম পরিবর্তিত)। তারপর বদলে গিয়েছে গড়িয়াহাট। এখন ব্র্যান্ডের ঝলকানি আর ফ্লাইওভার লুকোচুরি খেলে এসি বাসের জানলা দিয়ে। ট্রামগাড়ির শব্দ মিশে গিয়েছে ক্যালেন্ডারের পাতায়। অজয় এখন নিজেই দোকান সামলান। বণিকবাড়ির অদূরে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘আমরা তো জানতাম, বউটাকে পুড়িয়ে মেরেছে। খুবই অত্যাচার করত।’ চোখ পাকিয়ে পরের কথা, ‘বিরাট বড়লোক ওরা। ফাঁসির সাজা হয়েছিল তো! কেমন সেই সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করে দিল!’ বিচারের দরবারে সত্যি কী হয়েছিল তখন? প্রভাবশালী হাত? নাকি রাজনীতির লাল ফিতের বাঁধন?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন