নয়াদিল্লি: অর্থনীতির ভাষায় জিডিপি এবং জিডিপি পার ক্যাপিটার মধ্যে ফারাক অনেকটা। কারণ, জিডিপি হল কোনও রাষ্ট্রের জাতীয় গড় উৎপাদন। আর জিডিপি পার ক্যাপিটার অর্থ, তার মাথাপিছু হিসেব। অর্থাৎ, আর্থিক বৃদ্ধিতে প্রত্যেক দেশবাসীর ভূমিকা এবং প্রাপ্তি। জিডিপির নিরিখে ভারত চার নম্বরে থাকলেও, জিডিপি পার ক্যাপিটার হিসেবে কিন্তু ১৪০ নম্বরে। সোজা কথায়, দিনের শেষে আম জনতার প্রাপ্তি নিয়ে একঝাঁক প্রশ্ন। আর সেই প্রশ্ন এবার বেআব্রু বিশ্বব্যাঙ্কের দাবিতে। তারা জানাচ্ছে, ২০২৫ সালেও ভারতে প্রতি চারজন নাগরিকের মধ্যে একজন গরিব। ৩৫ কোটির বেশি মানুষকে এখনও পুষ্টিকর খাবার, জামাকাপড় ও মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়। অর্থাৎ, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের যে মৌলিক অধিকার, তার থেকেই বঞ্চিত এক-চতুর্থাংশ ভারতীয়। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য বা শিক্ষার অধিকারও তাদের কাছে দূর গ্রহের স্বপ্ন। ভারতের ৭ কোটি মানুষ তো চরম দারিদ্র্যের শিকার।
সম্প্রতি এনডিএ সরকারের ১১ বছরের পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দাবি করেছিলেন, সরকারের লক্ষ্য ছিল গরিবদের জীবনের সার্বিক উন্নতি ঘটানো। গরিবদের কল্যাণের জন্যই বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে কেন্দ্র। কিন্তু বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টের পর সেই সব প্রকল্প কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আদৌ সেই সব প্রকল্পের সুফল সাধারণ মানুষ পেয়েছে? নাকি সবটাই প্রচারের ঢক্কানিনাদ? এই প্রশ্ন ওঠার কারণ, ভারতে দারিদ্র্যসীমার মাপকাঠি ঠিক কী হবে, তা নির্ধারণের কাজ ২০১১ সালের পর আর হয়নি। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ১১ বছর কাটিয়ে ফেললেও দারিদ্র্যসীমার সেই মাপকাঠি ‘আপডেট’ করতে কোনও উদ্যোগ নেয়নি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, দিনপিছু উপার্জন ৩ ডলার বা ২৫০ টাকা থেকে ৪.২০ ডলারের (প্রায় ৩৬০ টাকা) মধ্যে থাকলে তাঁকে গরিব হিসেবে ধরা হয়। ৩৬০ টাকার বেশি দৈনিক আয় হলে নিম্নমধ্যবিত্ত। কিন্তু বিশ্বব্যাঙ্ক বলছে, বর্তমানে ভারত এখন উন্নয়নের যে স্তরে রয়েছে, তাতে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা আর দিনপিছু ৩ ডলার ধরা উচিত নয়। বরং প্রতিদিন ৪.২০ ডলার উপার্জনই দারিদ্র্যসীমার নতুন মানদণ্ড। শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশেও কিন্তু ৪.২০ ডলারকে মানদণ্ড ধরা হয়। অথচ ভারত সেই ফর্মুলা কার্যকরে নারাজ! তা সত্ত্বেও ৩৫ কোটির বেশি মানুষ ন্যূনতম সামাজিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। প্রতিদিন ২৫০ টাকা রোজগারেই প্রাণপাত হয় তাঁদের। যদি দৈনিক ৩৬০ টাকাকে মানদণ্ড ধরা হয়, তাহলে দরিদ্র মানুষের হিসেবটা ৩৫ কোটি ছাপিয়ে অনেক দূর চলে যাবে।
শহর ও গ্রামের দারিদ্র্যের ছবিটা কেমন? সেটাও উঠে এসেছে রিপোর্টে। দেখা যাচ্ছে, শহরে চড়া বাড়িভাড়া ও চাকরির অনিশ্চয়তার জন্য বহু মানুষ দারিদ্র্যসীমার একেবারে কিনারায় বসে রয়েছেন। গ্রামীণ ভারতেও ছবিটা আলাদা নয়। সেখানে পরিবার ছোট হয়ে যাওয়ায় মানুষের হাতে জমি কমেছে। শুধুমাত্র চাষবাসের উপর ভরসা করার ফলে গ্রামেও উপার্জন নিম্নগামী। ফলে অসুস্থতা বা চাকরি হারানোর মতো ঘটনা ঘটলেই সঙ্কট বাড়ছে। বিশ্বব্যাঙ্কের মতে, মানুষ যাতে দৈনিক অন্তত ৩৬০ টাকা রোজগার করতে পারে, তার জন্য সরকারকে অনেক কাজ করতে হবে।
বিরোধীদের অভিযোগ, দারিদ্র্যের এই ছবি যাতে সামনে না আসে, তার জন্য সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর জন্য মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইনডেক্সের (এমপিআই) মতো মানদণ্ডের উপর ভরসা করছে তারা। এই ধরনের সূচকগুলিতে খুঁটিনাটি তথ্য ধরা হয় না। মূলত শিক্ষা, নিকাশি, বিদ্যুত্ বা আবাসনের মতো বিষয়গুলি দেখা হয়। এমপিআই অনুসারে, ২০১৩ সালে ভারতে যেখানে ২৯ শতাংশ দারিদ্র্য ছিল, তা নাকি ২০২২ সালে ১১.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে এত সরকারি হিসেব-নিকেশের পরও দেশে ধনী ও গরিবের বিভেদ কমানো যাচ্ছে না। বর্তমানে ভারতের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশ এখন ১ শতাংশ মানুষের হাতে। আর ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মাত্র ৬.৪ শতাংশ সম্পদ। এই রিপোর্ট সামনে আসতেই সরব হয়েছে কংগ্রেস। তাদের দাবি, মোদি সরকার মানুষকে দুর্দশার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ যখন অন্ন-বস্ত্র জোগাড়েই হাঁসফাঁস করছে, তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁর ধনী বন্ধুদের সঙ্গে দামি মাশরুম খেতে ব্যস্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন