অজয় নদের দুই পাড়ে ইতিহাসের সন্ধানে - Aaj Bikel News | Latest Bengali News Bangla News, বাংলা খবর, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, তৃণমূল, বিজেপি খবর

Breaking

Aaj Bikel News | Latest Bengali News Bangla News, বাংলা খবর, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, তৃণমূল, বিজেপি খবর

Aaj Bikel is currently West Bengal's leading, popular, authentic and trustworthy digital media. Aaj Bikel News has become the voice of crores of readers and viewers.

শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

অজয় নদের দুই পাড়ে ইতিহাসের সন্ধানে


অজয় নদের দুই পাড়ে ইতিহাসের সন্ধানে

কিছুক্ষণ আগেই পেরিয়ে এসেছি এগারো মাইলের ঘন জঙ্গল। সবুজ মখমলে মোড়া সে পথের নিস্তব্ধতায় মন তাই বিভোর। সবকিছুকে পিছনে ফেলে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে। আর এরপরই গৌরাঙ্গপুর ব্লকের পাশ দিয়ে ‘আপন বেগে পাগলপারা’ অজয়ের হাতছানি। পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারির এক নম্বর ব্লকের অন্তর্গত ইছাই ঘোষের দেউল। অজয়ের পাড়ে যা ইতিহাসের এক জীবন্ত নিদর্শন। আগে এই স্থান ঢেকুরগড় নামে পরিচিত ছিল। দেউল প্রাঙ্গণের সাইনবোর্ড থেকে জানা যায় যে শিখর ধারায় নির্মিত এই মন্দির মধ্য অষ্টাদশ শতকে তৈরি হয়েছিল। তবে অনেক পুরাতাত্ত্বিক মনে করেন, এটি একাদশ শতকে নির্মিত। ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে সামন্তরাজা ইছাই ঘোষের উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টিয় একাদশ শতকে দ্বিতীয় মহীপালের সময়ে চোলদের আক্রমণে পাল বংশীয় রাজারা দুর্বল হয়ে পড়েন। সেই সময় ইছাই ঘোষ নিজেকে স্বাধীন সামন্তরাজা হিসাবে ঘোষণা করেন। অন্য দিকে গৌরেশ্বরের নির্দেশে তাঁকে দমন করতে আসেন মেদিনীপুরের আর এক সামন্ত রাজা কর্ণসেন। ইছাই ঘোষের হাতে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। এই যুদ্ধ জয়ের নিদর্শনকে স্মরণীয় করে রাখতে ইছাই ঘোষ এই দেউল নির্মাণ করেন। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করে থাকেন যে ইছাই এই দেউলের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা নন। ইছাইয়ের পরবর্তী কোনও গোপরাজা তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে এই মন্দির নির্মাণ করেন। দেউলের গঠনশৈলীতে দক্ষিণী ছাপে রাজেন্দ্র চোলের বঙ্গবিজয়ের ছাপ সুস্পষ্ট। বর্তমানে দেউলটি পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ বিভাগের অধীন।


ইছাই ঘোষের দেউলের অনতিদূরেই সাত দেউলের অবস্থান। খ্রিস্টিয় দশম শতাব্দীতে নির্মিত এই দেউল আকারে বিন্যস্ত ও পঞ্চরথ রীতির। প্রবেশদ্বারে ক্রমবর্ধমান খিলান অর্থাৎ করবেলড আর্চের অপূর্ব ব্যবহার পর্যটকদের আজও মুগ্ধ করে। আগে এখানে সাতটি দেউল থাকলেও কালের করাল গ্রাসে ছ’টি দেউল ধ্বংসপ্রাপ্ত। অন্তিম দেউলটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। পশ্চিমবঙ্গ পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ বিভাগের অধীন ১৩৩টি স্মৃতিস্তম্ভের মধ্যে এটি ৫৩তম। কাছেই গড় জঙ্গল আর শতরূপার মন্দির। সময় থাকলে পর্যটকরা সেখান থেকেও ঘুরে আসতে পারেন। দেউল দর্শনের পর হালকা জলযোগ সারলাম। 
এরপর গৌরাঙ্গপুরকে বিদায় জানিয়ে আমাদের গাড়ি অজয় নদের পাড়ে খেঁড়োবাটি পার হয়ে পশ্চিম বর্ধমানের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। বিদবিদার গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন অজয় পল্লির পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু সেতু পার হয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। কিছুটা এগনর পর অজয়ের দিগন্তবিস্তৃত বালুচর। 
অজয়ের হাঁটুজলে অনেক মানুষ স্নানরত। নদী পার হতে হতে মনে পড়ে যাচ্ছিল ‘গীতগোবিন্দ’ রচয়িতা কবি জয়দেব গোস্বামীর কথা। কথিত আছে, কবি জয়দেব পদব্রজে কাটোয়ায় গঙ্গা স্নান করতে যেতেন। দৈবীযোগে পুণ্যস্নান ছিল তাঁর জীবনের এক অপরিহার্য অঙ্গ। কিন্তু একবার মহা বিঘ্ন উপস্থিত হল। পত্নী পদ্মাবতী সেবার কেঁদুলিতে ছিলেন না। অথচ পরদিন পৌষ সংক্রান্তি অর্থাৎ মকর সংক্রান্তি। গৃহদেবতাকে একলা রেখে কীভাবে তিনি গঙ্গাস্নানে যাবেন? গভীর চিন্তায় নিদ্রামগ্ন হলেন সাধক কবি। মা গঙ্গা ভক্ত জয়দেবকে স্বপ্ন দর্শন দিলেন এবং আশ্বস্ত করলেন যে পরদিন সকালে কদম্বখণ্ডির ঘাটে তিনি নিজেই আবির্ভূতা হবেন। ঊষালগ্নে ঘুম ভেঙে গেল জয়দেবের। অস্থির হয়ে যাত্রা করলেন অজয়ের দিকে। হঠাৎ এক অলৌকিক কাণ্ড প্রত্যক্ষ করলেন তিনি। গত রাতের স্বপ্নদর্শন অনুযায়ী অজয়ের জল উজান স্রোতে বয়ে চলেছে এবং সেই স্রোতে ভেসে আসছে এক পদ্ম। অর্থাৎ ভক্তের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিতে মা 
গঙ্গা নিজেই হাজির হয়েছেন। এই ঘটনার সাক্ষী হতে তখন ঘাটে ভিড় জমে গিয়েছে। সকলেই কাল বিলম্ব না করে ঝাঁপ দিলেন সেই পবিত্র জলধারায়। আর সেইসময় 
থেকেই মকর সংক্রান্তির পবিত্র তিথিতে অজয়ের জলে পুণ্য স্নান করতে দূর-দূরান্ত থেকে অগণিত 
ভক্ত এসে উপস্থিত হন। জয়দেবের সময় থেকে এই পবিত্র তিথিতে প্রতি বছর তিন দিন ব্যাপী মেলা বসে। জনশ্রুতি আছে যে, এই কদম্বখন্ডির ঘাটেই জয়দেব রাধাবিনোদের বিগ্রহ পান।  
দেখতে দেখতে চলে এলাম বীরভূম জেলার ইলামবাজারে অবস্থিত মহাতীর্থধাম কেঁদুলিতে। ‘গীতগোবিন্দ’ রচয়িতা জয়দেবের জন্মভূমি এই কেঁদুলি গ্রামেই বর্ধমান রাজ কীর্তিচাঁদ বাহাদুর ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রীশ্রী রাধাবিনোদ মন্দির নির্মাণ করেন। দক্ষিণদ্বারী ইটের সুউচ্চ নবরত্ন মন্দির। মন্দিরের সেবায়েতের কাছ থেকে জানলাম যে, লক্ষ্মণসেনের সভাকবি জয়দেবের বাসভূমির ওপরই এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত। ইট নির্মিত, চতুর্বর্গ এই মন্দিরের উপরিভাগে নয়টি রেখ শিখর নবরত্নের আকারে একটি মধ্যভাগে এবং নিম্ন দু’টি ধাপের চারটি 
কোনায় বিন্যস্ত। মন্দিরগাত্রের টেরাকোটার কাজে অর্থাৎ নকশি ইটে বিষ্ণুর দশাবতার ও রামায়ণী কাহিনিচিত্রের বর্ণনা পাওয়া যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, মন্দিরের গর্ভগৃহে  কদম্বখণ্ডির ঘাটে প্রাপ্ত জয়দেবের সেই রাধাবিনোদের মূর্তি নিত্য পূজিত। শুধু তাই নয়, তিনটি শালগ্রাম শিলা, রাধাগোবিন্দর অনালিঙ্গ আবদ্ধ যুগল বিগ্রহ এবং জয়দেব ও পদ্মাবতীর মূর্তিও নিত্য পূজিত। এই মন্দিরেই সযত্নে সংরক্ষিত আছে জয়দেবের স্বহস্তে লিখিত ‘গীতগোবিন্দ’- র বিচ্ছিন্ন কিছু পাতা।
কাছেই কুশেশ্বর শিব মন্দির। অনেকের ধারণা জয়দেব প্রথম জীবনে শৈব ছিলেন। এলাকাবাসীরা জানালেন, এই অঞ্চলে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা মহামারীর প্রাদুর্ভাব হলে গ্রামবাসীরা ১০৮ ঘড়া জল দিয়ে কুশেশ্বর শিবলিঙ্গকে স্নান করান। জয়দেব-কেঁদুলির অন্যতম দর্শনীয় স্থান এই শিব মন্দির।
জনশ্রুতি আছে,কবি জয়দেব বৃন্দাবনে দেহরক্ষা করেন। তখন তাঁর ভক্তরা সেখান থেকে মাটি এনে কদম্বখণ্ডির শ্মশানঘাটে এক সমাধিবেদী নির্মাণ করেন। কদম্বখণ্ডির ঘাটে সত্যবানের এক মূর্তি রয়েছে। সধবা মহিলা অনেকেই সেই সত্যবানের মূর্তিতে পরম ভক্তিভরে সিঁদুর দান করেন। এতে তাঁদের সিঁদুর অক্ষয় হয় বলে তাঁদের বিশ্বাস।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Loading...