বহরমপুর: মুর্শিদাবাদ-জিয়াগঞ্জ ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা নিয়তি (নাম পরিবর্তিত)। শীর্ণকায় চেহারা। খাতায় কলমে বয়স ১৫ হলেও, দেখে মনে হয় ১১-১২। দশ বছর বয়সে নিয়তির বিয়ে হয়। এখন তাঁর কোলে দুই সন্তান। নিয়তির প্রথম সন্তান আসে তাঁর যখন মাত্র ১১ বছর বয়স, তখনই। আড়াই বছর যেতে না যেতেই আরও এক সন্তানের জন্ম দেয় সে। স্বামী মাদক নিতে নিতে মারা গিয়েছে। মা এবং দুই বাচ্চার দায়িত্ব কে নেবে? শ্বশুরবাড়ির লোকরা সন্তানসহ নিয়তিকে তাড়িয়ে দিয়েছে। অগত্যা পাশের গ্রামে বাপের বাড়িতে ফিরে এসেছে সে। শুধু নিয়তিই নয়, এরকম করুণ পরিণতি জেলার বহু নাবালিকার জীবনে ঘটেছে এবং এখনও ঘটছে। মুর্শিদাবাদ জেলায় নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলায় উদ্বেগে প্রশাসনিক আধিকারিকরা। জেলা প্রশাসন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই জেলার প্রতি ১০০ জন প্রসূতির মধ্যে ২২ জনই নাবালিকা। বাল্যবিবাহ রোধে লাগাতার প্রচার চালাচ্ছে রাজ্য সরকার। তবুও পুলিস-প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রতি বছরই বিয়ে হচ্ছে হাজার হাজার নাবালিকার। বছর ঘোরার আগে অন্তঃসত্ত্বাও হয়ে পড়ছে তারা। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই জন্ম দিচ্ছে সন্তানের। অধিকাংশ সদ্যোজাত অপুষ্টিতে ভুগছে। নাবালিকার মায়েদের হাল একই।
জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২২ শতাংশ নাবালিকা প্রসূতির অনেকেই অপুষ্ট শিশুর জন্ম দিচ্ছে। মুর্শিদাবাদের মধ্যে সদর মহকুমায় পরিস্থিতি সব থেকে খারাপ। বহরমপুর ব্লকে ৩০ শতাংশের বেশি নাবালিকা প্রসূতির খোঁজ মিলছে এবং হরিহরপাড়া ব্লকে ৩৪ শতাংশের বেশি নাবালিকা প্রসূতি রয়েছে। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, বাল্যবিবাহ আটকাতে না পারলে নাবালিকা প্রসূতির হার কিছুতেই কমানো যাবে না। মূলত গ্রামের দিকে একাধিক সন্তান থাকায় মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে চাপ মুক্ত হতে চান অভিভাবকরা। এই সমস্ত অভিভাবকদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করছে জেলা প্রশাসন।
নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী শশী পাঁজা বলেন, নাবালিকা মাতৃত্ব নিয়ে লাগাতার সচেতন করা হয়। তাতেই গতবারের তুলনায় এবার এই পরিসংখ্যান কিছুটা কমেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যাশ্রী প্রকল্প মূলত বাল্যবিবাহ রোধ করতেই করা। পাশাপাশি মেয়েরা যাতে শিক্ষিত হয়ে স্বনির্ভর হতে পারে তাও ছিল লক্ষ্য। নাবালিকা মাতৃত্ব এবং নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বার মৃত্যুর হার আমাদের রাজ্যে অনেক কমছে। আরও কমাতে হবে। কীভাবে সামাজিক এই সূচকগুলি আরও ভালো করা যায়, তার জন্য আমরা কাজ করছি। ডবল ইঞ্জিন সরকারের রাজ্যগুলিতে দেখবেন তারা বাংলার থেকে এইসব সূচকে অনেক পিছিয়ে আছে। তাদের এখনও শোচনীয় অবস্থা।
মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক রাজর্ষি মিত্র সম্প্রতি বাল্য বিবাহ নিয়ে সচেতনতার একটি অনুষ্ঠানে এসে বলেন, আমাদের জেলায় ২২ শতাংশ নাবালিকা মা। বহরমপুর ব্লকে ৩১ শতাংশের কাছাকাছি এবং হরিহরপাড়া ব্লকে ৩৪ শতাংশ। সব কাজেই গাফিলতি থাকে। ভালো করে সার্ভে করলে সংখ্যা হয়তো এই হার আরও বাড়বে। আমাদের যেন তেন প্রকারেণ বাল্যবিবাহ আটকাতে হবে। প্রশাসনের এখন দুটো কাজ— একদিকে সচেতন করা আর যদি মানুষ সচেতন না হয়, তাহলে আইন প্রয়োগ করা। আমরা বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে এবার কড়া আইন প্রয়োগ করছি। ডিস্ট্রিক্ট চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারপার্সন সোমা ভৌমিক বলেন, জেলাজুড়ে আরও সচেতনতা দরকার। গত একমাস ধরে জেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে ২১০টি নাবালিকা বিয়ে আটকেছে। বিয়ের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন