ওয়াশিংটন: কান ফাটানো শব্দ। আগুন আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী। বিস্ফোরণে ভেঙে পড়া বহুতলের কঙ্কাল। আতঙ্কের প্রহর কাটাচ্ছে তেহরান। একই অবস্থা তেল আভিভেও। যুদ্ধ পঞ্চম দিনে পড়েছে। কিন্তু এখনও সমান আগ্রাসী ইজরায়েল ও ইরান— দু’পক্ষই। সংঘাতের এই আবহেই মঙ্গলবার দুপুরে (মার্কিন সময়) সোশ্যাল মিডিয়ায় তেহরানকে চরম হুঁশিয়ারি দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ‘ইরানের আকাশ এখন আমাদের দখলে। তথাকথিত সর্বোচ্চ নেতা (আয়াতোল্লা আলি খামেনেই) ঠিক কোথায় লুকিয়ে, সেটাও আমরা জানি। তবে এখনই ওঁকে মারব না। আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করুন!’ এই হুঁশিয়ারিকে কেন্দ্র করে পশ্চিম এশিয়ার সামগ্রিক পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সকালেই নাগরিকদের ‘নিরাপত্তা’র স্বার্থে তেহরান খালি করার কথা জানিয়েছিলেন ট্রাম্প।
সোমবার একই সতর্কবার্তা জারি করেছিল ইজরায়েলও। এরপরই তেহরান ছাড়ার হিড়িক পড়ে যায়। তার জেরে যানজটে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ইরানের রাজধানী শহর। প্রায় ১৪ ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যাম লেগে ছিল তেহরান থেকে পশ্চিমমুখী রাস্তায়। অনেকেরই অভিমুখ কাস্পিয়ান সাগর সংলগ্ন এলাকা। জ্বালানি ভরতে গ্যাস স্টেশনগুলিতে লম্বা লাইন দেখা যায়। ভারত সহ বহু দেশ নিজেদের নাগরিকদের ইতিমধ্যেই ইরান থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোথায় পালাচ্ছেন সাধারণ ইরানিরা? সোমবার সকালেই আরাশ নামে এক বাসিন্দা সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন, ‘তেহরান ছেড়ে যাচ্ছি। আপাতত গন্তব্য উত্তর-পশ্চিম ইরানের শহর কাজভিন।’ মাত্র ঘণ্টা দেড়েক দূরত্বের সেই যাত্রাপথেও পাঁচ ঘণ্টা লেগে গিয়েছে বলেই খবর। তবে অনেকেরই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাওয়ার নেই। সংবাদমাধ্যমে নিজেদের হতাশা ব্যক্ত করেছেন তাঁরা।
ইজরায়েলি বাহিনী অবশ্য শুধু হুঁশিয়ারিতে আটকে নেই। লাগাতার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তেল আভিভের দাবি, তাদের নিখুঁত এয়ার স্ট্রাইকে খতম ইরানের ‘যুদ্ধকালীন সেনা সর্বাধিনায়ক’ মেজর জেনারেল আলি শাদমানি। তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের ডান হাত বলে পরিচিত। পূর্বসূরি মেজর জেনারেল গোলাম আলি রশিদের মৃত্যু হয়েছে গত শুক্রবার। ঘটনাচক্রে দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র চারদিনের মাথায় ইজরায়েলি হামলায় প্রাণ হারালেন শাদমানিও।
ইজরায়েলের হামলার পরপরই প্রত্যাঘাত হানে ইরান। তেহরানের পাল্টা দাবি, তাদের মিসাইল হামলায় গুঁড়িয়ে গিয়েছে তেল আভিভে অবস্থিত ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি সেন্টার। দু’পক্ষের তীব্র সংঘাতের মধ্যেই ইজরায়েলের পাশে দাড়িয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে জি-৭ গোষ্ঠী। সাফ জানানো হয়েছে, ইজরায়েলের ‘আত্মরক্ষার’ অধিকার রয়েছে। পরমাণু অস্ত্র কোনওভাবেই ইরানের নাগালে আসতে দেওয়া যাবে না। একই বক্তব্য স্বয়ং ট্রাম্পেরও। কানাডায় জি-৭ বৈঠকের মাঝপথেই তিনি তড়িঘড়ি ওয়াশিংটনের উদ্দেশে রওনা দেন। আচমকা কেন এই সিদ্ধান্ত? ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাক্রঁ ইঙ্গিত দেন, সম্ভবত ইরান-ইজরায়েল সংঘর্ষবিরতি ঘোষণার জন্যই মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রস্থান। যদিও কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই দাবি নস্যাৎ করে দেন ট্রাম্প স্বয়ং। তাঁর তীর্যক মন্তব্য, ফরাসি প্রেসিডেন্ট হামেশাই ভুল বকেন! ওয়াশিংটন ফেরার পথে এয়ারফোর্স ওয়ান বিমানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প আরও বলেন, ‘নিছক সংঘর্ষ বিরতি নয়, সত্যিকারের হেস্তনেস্ত করব। দু’দিনের মধ্যেই সবাই জানতে পারবেন।’ এরপরই তাঁর চরম হুঁশিয়ারি।
সব মিলিয়ে মহামারী পর্বে লকডাউনের স্মৃতি ফিরে এসেছে তেহরান ও তার আশপাশে। এদিন সকাল থেকেই বন্ধ ছিল অধিকাংশ দোকানপাট। খোলেনি প্রাচীন গ্র্যান্ড বাজারও। ইরানের ব্যাঙ্কে সাইবার হানা হয়েছে। নগদের জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে তেহরানে। চিকিৎসক ও নার্সদের সব ছুটি বাতিল করেছে সরকার। তবে প্রাণরক্ষায় সাধারণ মানুষ কী করবেন, সেবিষয়ে সরকারের তরফে কোনও পরামর্শ নেই। ফলে অনিশ্চয়তার পথে পাড়ি দিচ্ছেন কাতারে কাতারে তেহরানবাসী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন