নিজস্ব প্রতিবেদন: ২০২৫-এর শুরুতেই কলকাতা দুটি ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়েছে। প্রথমটি হয়েছিল ৭ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয়টি ২৮ ফেব্রুয়ারি। এই দুই ভূমিকম্পই শহরবাসীর মনে একটাই প্রশ্ন জাগিয়ে তুলেছে, এমন ঘটনা কি ঘন ঘন ঘটতে থাকবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কলকাতার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভবিষ্যতে আরও ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে।
কলকাতার ভূমিকম্পের কারণ টেকটোনিক প্লেটের প্রভাব। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মতে, এই ভূমিকম্প সাধারণত পৃথিবীর অভ্যন্তরে টেকটোনিক প্লেটগুলোর নড়াচড়ার ফলে ঘটে। কলকাতা অবস্থিত ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলের কাছাকাছি, যেখানে টেকটোনিক চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মতে, এই প্লেটগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ এবং মৃদু নড়াচড়া ভূমিকম্পের সৃষ্টি করছে। কলকাতা মূলত গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে মাটি তুলনামূলকভাবে নরম। ফলে ভূমিকম্পের কম্পন এখানে অনেক বেশি অনুভূত হয়। এই ভূমিকম্পগুলি সরাসরি শহরের নিচে উৎপন্ন না হলেও, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর ভূমিকম্পের প্রভাব কলকাতায় প্রবলভাবে অনুভূত হয়। 'সিসমিক জোন' হিসেবে কলকাতা অবস্থান তাই জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া সতর্কবার্তা দিয়েছে যে কলকাতা এখন 'সিসমিক জোন' বা ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। ভারতের সিসমিক জোনগুলোকে সাধারণত চারটি ভাগে বিভক্ত। সিসমিক জোন ২, ৩, ৪ এবং ৫। কলকাতা এবং আশপাশের অঞ্চল সিসমিক জোন ৩ ও ৪-এর মধ্যে পড়ে, যেখানে মাঝারি থেকে শক্তিশালী ভূমিকম্পের সম্ভাবনা থাকে। উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং, সিকিম, এবং নেপাল সীমান্তের অংশগুলো সিসমিক জোন ৫-এ পড়ে, যা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও মায়ানমারের ভূমিকম্পগুলোর প্রভাবও কলকাতায় অনুভূত হতে পারে। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কলকাতার জন্য ভূমিকম্প ভবিষ্যতে একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে।
কলকাতা মূলত ভূমিকম্পপ্রবণ শহর হিসেবেই পরিচিত। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, মাঝে মাঝে ধীরে ধীরে বাড়ছে। ৭ জানুয়ারির ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৪.১ এবং ২৮ ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৪.২। যদিও এগুলো বড় কোনো ক্ষতি করেনি, তবুও ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের সংখ্যা বাড়বে এবং শহরবাসীকে এটাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নিতে হবে, ঠিক যেমন ফি-বছর ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা গা-সওয়া হয়ে গেছে। তবে বড় ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই যায়। কলকাতায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বড় পুরোনো স্থাপত্য ও অবকাঠামো সামনে আসে। কলকাতার বহু পুরোনো ভবন ও কাঠামো ভূমিকম্প প্রতিরোধের জন্য নির্মিত হয়নি। বিশেষ করে উত্তর কলকাতার শতাব্দীপ্রাচীন ভবনগুলো ভূমিকম্প সহ্য করতে পারবে না। অপরিকল্পিত নির্মাণ হওয়ার কারণে অসংখ্য বহুতল ভবন, নরম মাটির উপর নির্মিত অপরিকল্পিত স্ট্রাকচার, এবং অপর্যাপ্ত ফাউন্ডেশন ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হতে পারে। জনসংখ্যার ঘনত্বের জন্য কলকাতা অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ শহর। ভূমিকম্পের কারণে যদি কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করাও কঠিন হবে। ভূমিকম্পের তরঙ্গের বিস্তার হয় নরম মাটির কারণে, যা ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। ভূমিকম্প মোকাবিলায় ব্যক্তিগত এবং সরকারি পর্যায়ে সচেতনতা ও পূর্বপ্রস্তুতি থাকা জরুরি। জাপানের মতো ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোর মডেল অনুসরণ করে কলকাতায় ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন